বই পড়ার অভ্যাস কিভাবে গড়ে তোলা যায়?

0
4KB

বই পড়া একটি চমৎকার অভ্যাস। এটি আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে, কল্পনাশক্তি বাড়ায় এবং মননশীলতা গড়ে তোলে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির প্রভাবের কারণে অনেকেই বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছেন। কিন্তু একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলার জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রয়োজন সচেতন প্রচেষ্টা এবং কিছু কৌশল। এই রচনায় বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিক কৌশলগুলো বিশ্লেষণ করা হবে।

বই পড়ার অভ্যাস সংক্রান্ত প্রতিবেদন

বাংলাদেশে বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণায় দেখা গেছে, শহুরে জীবনে প্রযুক্তি আমাদের বই পড়ার অভ্যাস অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে, শিশুদের মধ্যে এই অভ্যাস অনেকটাই বিলুপ্তপ্রায়। স্কুল-কলেজে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমছে। অন্যদিকে, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে লাইব্রেরির অভাব এবং বইপাঠের সুযোগ সীমিত হওয়ায় সেখানে এই অভ্যাস তেমন একটা গড়ে ওঠেনি।

তবে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষণীয়। বিভিন্ন বইমেলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বই-সংক্রান্ত আলোচনা এবং নতুন নতুন বইপড়া আন্দোলনের ফলে তরুণ সমাজে বই পড়ার অভ্যাস ফের ফিরে আসছে। বিশেষ করে, এটরিডস (ATReads)-এর মতো বইপাঠকদের সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন যেভাবে

১. নিজের পছন্দের বই খুঁজে বের করুন: বই পড়া শুরু করার জন্য প্রথমে এমন বিষয়বস্তু নির্বাচন করুন যা আপনার আগ্রহের সঙ্গে মেলে। রোমাঞ্চ, সায়েন্স ফিকশন, কবিতা, বা জীবনী—যা পড়তে ভালো লাগে তাই দিয়ে শুরু করুন।

২. প্রতিদিন বই পড়ার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন: যেমন, সকালে উঠে বা রাতে ঘুমানোর আগে ২০-৩০ মিনিট বই পড়ার চেষ্টা করুন। এই অভ্যাস নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে মজবুত হবে।

৩. পড়ার জায়গা নির্ধারণ করুন: একটি শান্ত পরিবেশে বসে পড়লে মনোযোগ বাড়ে। একটি নির্দিষ্ট জায়গা (যেমন আপনার প্রিয় চেয়ার বা বারান্দা) পড়ার জন্য নির্ধারণ করুন।

৪. মোবাইল ও প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকুন: বই পড়ার সময় মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার না করাই ভালো। এগুলো মনোযোগ নষ্ট করতে পারে।

৫. লক্ষ্য স্থির করুন: প্রতি মাসে একটি বা দুটি বই শেষ করার লক্ষ্য স্থির করুন। এটি আপনার অভ্যাস গঠনে সহায়ক হবে।

শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে যা করবেন

শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠলে তা আজীবন টিকে থাকে।

১. বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন: শিশুদের রঙিন চিত্রসহ গল্পের বই কিনে দিন। তাদের জন্মদিন বা উৎসবে বই উপহার দিন।

২. পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন: বাড়িতে একটি ছোট লাইব্রেরি বা বইয়ের তাক তৈরি করুন। শিশুদের উৎসাহিত করতে তাদের পছন্দমতো বই সেখানে রাখুন।

৩. শুরু করুন গল্প বলা দিয়ে: শিশুদের ঘুমানোর আগে একটি ছোট গল্প পড়ে শোনান। গল্পের মাধ্যমে তারা বইয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে।

৪. উদাহরণ হয়ে উঠুন: যদি শিশুরা দেখে যে বাবা-মা বই পড়ছেন, তাহলে তারাও উৎসাহী হবে। শিশুদের সামনে নিজেও বই পড়ুন।

৫. বই পড়াকে মজার অভিজ্ঞতায় পরিণত করুন: তাদের বইয়ের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করুন, গল্প বলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করুন।

আমি কিভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম

২০০৩ সাল। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেখানে পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ, এবং ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই সময়টাই ছিল আমার জীবনে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার সূচনা।

আমার বন্ধু আন্দালিব এর বড় ভাই, আদনান ভাই, আমাদের এলাকার পরিচিত একজন বইপ্রেমী। তিনি আমাদের কাছে কেবল একজন বড় ভাইই নন, একজন পরামর্শদাতা, গাইড, এবং অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। তিনি নিয়মিত বই পড়তেন এবং বিভিন্ন লেখকের বই নিয়ে আলোচনা করতেন।

একদিন তিনি আমাকে বললেন, "পড়াশোনার বাইরে তোমার নিজের জন্যও কিছু পড়া উচিত। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ—যা মন চায়, তাই পড়ো। এতে তোমার মনটাও ভালো থাকবে এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হবে।" তার এই কথাগুলো আমার মনের গভীরে দাগ কাটল।

একদিন আদনান ভাই আমাকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ বইটি দিলেন। তিনি বললেন, "এই বইটা পড়ো, তোমার ভেতরে একটা আলাদা ভাবনা জন্মাবে।" প্রথমে ভয় লাগছিল এত বড় একটি বই পড়তে। কিন্তু শুরু করার পর প্রতিটি পৃষ্ঠায় আমি নতুন কিছু শিখতে লাগলাম—জীবন, সম্পর্ক, সমাজের গভীর দৃষ্টিভঙ্গি।

এরপর থেকেই আমার বই পড়ার যাত্রা শুরু। তখন আন্দালিব এর সঙ্গে বই বিনিময় করতাম। তার কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’, এবং আরও অনেক বই নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। প্রতিদিন রাতে পড়াশোনা শেষ করে এক ঘণ্টা করে গল্পের বই পড়তাম। ধীরে ধীরে এটা আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেল।

আদনান ভাই আমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতেন। তিনি শেখালেন কীভাবে বই নির্বাচন করতে হয়, এবং কীভাবে পড়ার অভ্যাস ধরে রাখতে হয়। তিনি বলতেন, "যত বেশি পড়বে, তত বেশি জানবে। আর এই জানাটাই তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।"

বই পড়ার এই অভ্যাস আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করল। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য গল্পের বই হয়ে উঠল আমার প্রধান সঙ্গী। এই অভ্যাস শুধু আমাকে আনন্দই দেয়নি, বরং আমার চিন্তার গভীরতা এবং লেখার দক্ষতাও বাড়িয়েছে।

আজ ২০ বছরের বেশি সময় পরও আমি সেই দিনগুলোকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। আদনান ভাইয়ের অনুপ্রেরণা এবং তার দেওয়া প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা আমাকে আজীবন বইপ্রেমী করে তুলেছে।

বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রেরণা

বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রেরণার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখবেন, বই আপনাকে কেবল জ্ঞান দেবে না, বরং মানসিক শান্তিও এনে দেবে। বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী পড়ুন—তারা কীভাবে বই থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তা জানুন।

একজন পাঠক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে তা কল্পনা করুন। প্রতিটি পৃষ্ঠা আপনাকে নতুন কিছু শিখতে সাহায্য করবে। বই পড়ার ফলে চিন্তা-ভাবনার গভীরতা বাড়বে, লেখালেখির দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং একসময় আপনি নিজেও হয়তো একজন লেখক হয়ে উঠতে পারবেন।

আজকের যুগে যখন সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে, তখন বই পড়া আপনাকে জীবনের গভীর দৃষ্টিভঙ্গি দেবে। সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে ATReads-এর মতো প্ল্যাটফর্মে যোগ দিন। এখানে আপনি অন্য পাঠকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারবেন, যা আপনাকে আরও বেশি উৎসাহ দেবে।

উপসংহার

বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা খুব কঠিন কিছু নয়, তবে এটি নিয়মিত চর্চা এবং আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যমে সম্ভব। বইয়ের জগৎ একবার আপনার কাছে খুলে গেলে আপনি কখনো একঘেয়েমি অনুভব করবেন না।

তাই, আজই একটি বই হাতে নিন। হয়তো সেই বইটি আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। মনে রাখবেন, একটি ভালো বই শুধু আপনাকে আনন্দই দেবে না, এটি আপনার জীবনবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।

Like
Yay
5
Suche
Gesponsert
Kategorien
Mehr lesen
Literature
বই পড়া কি ক্যারিয়ারে সাহায্য করে?
হ্যাঁ, বই পড়া ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্যভাবে সাহায্য করে। এটি কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং একজন...
Von Razib Paul 2024-11-29 13:30:36 0 4KB
Tutorial
লেখার সৃজনশীলতা: ATReads রাইটিং চ্যালেঞ্জে এর কতিপয় কথা।
লেখার সৃজনশীলতা: কিভাবে আপনার কল্পনা শক্তি প্রকাশ করবেন লেখা কেবলমাত্র শব্দের সাজানো নয়, এটি...
Von WriteAhead Bangladesh 2024-12-02 14:24:11 0 6KB
Book Reviews & Literary Discussions
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে চোখের বালির সার্থকতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি (১৯০৩) উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি,...
Von Book Club Bangladesh 2025-02-22 12:26:55 0 9KB
Lifelong Learning
The Benefits and Importance of Lifelong Learning
Lifelong learning is a concept that has gained increasing recognition in recent years. It refers...
Von Nancy Perez 2023-09-09 06:28:25 0 19KB
Education & Learning
বর্ষসেরা বাংলাদেশ
বর্ষসেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্মান: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিজয় বাংলাদেশের...
Von Razib Paul 2024-12-22 13:14:27 1 4KB
AT Reads https://atreads.com