শিক্ষক জুলফিকার আলীকে অভিবাদন

1
5K

সেদিন প্রথম আলোয় এ নিউজ দেখলাম, ভাবলাম কিছু লিখি, তাই লিখতে বসেছি। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ছবিলাপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক এস এম জুলফিকার আলীর বটগাছের প্রতি গভীর মমতাময় ভালোবাসার গল্প পড়ার পর এ দুটি লাইন মনে পড়লো: "এমন একটি দেশ চাই, যেখানে সবুজ প্রকৃতির আড়ালে বেঁচে থাকবে মানুষের স্নিগ্ধতা।" কয়েক দশক ধরে তিনি বটগাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের পথে পথে। শুধু গাছ লাগিয়েই থেমে নেই তিনি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও পাঠাগার গড়াতেও এগিয়ে তিনি। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম ও সমাজসেবা তৈরি করেছে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা।

জুলফিকার আলী একজন শিক্ষক, কিন্তু তার পরিচয় শুধুমাত্র শিক্ষকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কে জি এস মহর সোবাহান মফিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শুধু বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে তিনি নয়, বাইরের দুনিয়াতেও তিনি একজন মহান নেতা।

 ১৯৮২ সাল থেকে তিনি নানা জায়গায় গাছ লাগাতে শুরু করেছেন। তার এ মহৎ উদ্যোগের ফলে, আজ মেলান্দহ, জামালপুর সদর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলাসহ বিস্তৃত এলাকা গাছের ছায়ায় ঢেকে গেছে। বিশেষত, বটগাছের প্রতি তার গভীর মায়া ও ভালোবাসা তার কাজের মূল অবলম্বন।

জুলফিকার আলী সম্পর্কে জানলে বোঝা যায়, একটি গাছের চারা তার কাছে শুধু একটি গাছ নয়, এটি সমাজের জন্য একটি অবদান। বটগাছের প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসা এবং উদ্দেশ্য বোঝানোর পর, তার মধ্যে যে গভীর মানবিকতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আবেগ রয়েছে, তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

তার মতে, “বটগাছের ছায়া শীতল, সেখানে একত্রে অনেক মানুষ বসতে পারে, আর গাছটি সহজে মরেও না। দেশে একসময় অনেক বটগাছ ছিল, কিন্তু এখন সংখ্যায় কমে গেছে। বটগাছ লাগালে আমি আলাদা শান্তি পাই।”

এ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক বটগাছসহ মোট ১০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন। প্রতিবছর তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের গাছের চারা উপহার দেন, যেন তারা জীবনে কোনো জায়গায় গিয়ে এসব গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায়।

এমনকি বিয়েতে উপহার হিসেবে গাছের চারা নিয়ে যান। কিছু মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও তিনি কখনও এই কাজ থেকে বিরত হননি, কারণ তিনি জানেন, তার এই ছোট্ট উদ্যোগ সমাজে বৃক্ষপ্রেম ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে।

এ ছাড়া, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তার অবদানও অসাধারণ। গ্রামে কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পেলেই তিনি ছুটে যান। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে কিশোরীদের বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করেন। তার এই নিরলস প্রচেষ্টায় অনেক কিশোরীকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

২০০১ সালে, জুলফিকার আলী একজন শিক্ষক হিসেবে তার প্রজ্ঞা ও মানবিকতার পরিচয় আরও এক ধাপ এগিয়ে দেন। তিনি তার বাড়ির সামনে নিজের জায়গায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে গ্রামের মানুষদের বই পড়ার জন্য স্থান দেওয়া হত। পাঠাগারের পাশের পুকুরপাড়ে বসে বই পড়ার ব্যবস্থা ছিল, আর তার সঙ্গে ছিল গাছের ছায়া, যা বই পড়াকে আরও উপভোগ্য করে তুলত।

তবে, সরকার পতনের পর দুর্বত্তরা পাঠাগারের বইগুলো পুকুরে ফেলে দেয়, তবে তিনি হাল ছাড়েননি। বর্তমানে তিনি নতুন করে পাঠাগারটি চালু করার উদ্যোগ নিচ্ছেন, যা তার অদম্য মানবিকতা ও সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার প্রমাণ।

এমন একজন মানুষ যিনি প্রকৃতি, সমাজ ও শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে চলেছেন, তার মতো ব্যক্তিদের প্রয়োজন আমাদের সমাজে। একটি গাছের চারা, একটি পাঠাগার, একটি ভালোবাসা—এসবই সেই শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি যা সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।

জুলফিকার আলী আমাদের দেখিয়েছেন, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আর মানবতার প্রতি দায়িত্ববোধের মধ্যে এক নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি কীভাবে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে।

তিনি শুধু একটি শিক্ষক নন, তিনি একজন প্রকৃতিপ্রেমী, একজন সমাজসেবক, এবং এক নতুন প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। এই ধরনের অদম্য মনোভাব আমাদের সমাজে আরও বেশি প্রয়োজন। জুলফিকার আলীর মতো মানুষের অবদান ও প্রচেষ্টা কেবল তার এলাকার জন্য নয়, বরং পুরো দেশের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।

তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই এবং আশাবাদী যে, তাঁর মতো আরও অনেক শিক্ষক ও সমাজসেবক উঠে আসবেন, যারা মানুষের জন্য কাজ করবেন, সমাজে পরিবর্তন আনবেন।

Like
Love
9
Pesquisar
Patrocinado
Categorias
Leia Mais
Storytelling
গল্প লেখার নিয়ম
গল্প বলা বা লেখা মানব সভ্যতার এক অনন্য শিল্প। এটি কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের অভিজ্ঞতা,...
Por WriteAhead Bangladesh 2024-12-02 13:54:01 0 7K
Local
মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র বিভক্তকারী সীমারেখা কোনটি?
সনোরা লাইন হলো মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্তকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমারেখা, যা দুই দেশের...
Por Knowledge Sharing Bangladesh 2024-12-05 05:43:12 0 4K
Education & Learning
কোন বৃহত্তম সংখ্যা দিয়ে 564 ও 630 কে ভাগ করলে প্রতিক্ষেত্রে 3 ভাগশেষ থাকবে?
চূড়ান্ত উত্তর: বৃহত্তম সংখ্যা হলো ৩৩। সমস্যাটি সমাধান করতে আমরা ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করব। আমাদের...
Por Knowledge Sharing Bangladesh 2024-12-17 05:24:44 1 4K
Book Reviews & Literary Discussions
The Human Body Coloring Book
DK Publishing’s The Human Body Coloring Book offers an engaging, interactive approach to...
Por Books of the Month 2024-12-31 12:06:01 1 4K
Lifelong Learning
MAHABHARATA (JAYA - BHARATA)
They were perhaps whispers of God, or maybe insights of the wise. They gave the world meaning and...
Por Pallavi Ghosh 2024-04-07 03:44:04 0 10K
AT Reads https://atreads.com