বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার কারণ  

7
5χλμ.

বই পড়া একসময় মানুষের অন্যতম প্রধান বিনোদন এবং জ্ঞানের উৎস ছিল। মানুষ সময় পেলেই বইয়ের পাতা উল্টে গল্প, কবিতা, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মধ্যে ডুবে যেত। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, বই পড়ার অভ্যাস আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।

প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগে আমরা বইয়ের পরিবর্তে অন্য মাধ্যমগুলোতে বেশি সময় ব্যয় করছি। এই পরিবর্তনের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, জীবনের ব্যস্ততা, এবং সঠিক পঠনসংস্কৃতির অভাব উল্লেখযোগ্য।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গেলে, ছোটবেলায় আমি যখন প্রথম গল্পের বই পড়তে শুরু করি, তখন মনে হতো, আমি যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছি। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত। কিন্তু বর্তমান সময়ে, এমন অনেকেই আছে যারা বইয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। তারা সময় কাটায় মোবাইল স্ক্রিনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, কিংবা ভিডিও গেম খেলে। এই প্রবণতা আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।  

বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার প্রধান কারণ  

 ১. প্রযুক্তির অগ্রগতি ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব  
আজকের দিনে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার এবং ট্যাবলেট আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার ফলে মানুষের বিনোদনের ধরন বদলে গেছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের অধিকাংশ সময় দখল করে নিচ্ছে। ভিডিও কনটেন্ট এবং শর্ট ফরম্যাটের উপস্থাপনা আমাদের মনোযোগের পরিধি সংকীর্ণ করে তুলেছে। আমরা এখন ধৈর্য ধরে একটি বই পড়ার চেয়ে কয়েক মিনিটের ভিডিও দেখে আনন্দ পেতে বেশি পছন্দ করি।  

 ২. জীবনের ব্যস্ততা ও সময়ের অভাব  
বর্তমান যুগের মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি ব্যস্ত। কর্মক্ষেত্রের চাপ, শিক্ষার প্রতিযোগিতা, এবং পারিবারিক দায়িত্বের মাঝে বই পড়ার জন্য আলাদা সময় বের করা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। একসময় অবসর সময় মানেই ছিল বই পড়া, কিন্তু এখন অবসরের সংজ্ঞা বদলে গেছে। মানুষ অবসর কাটাতে পছন্দ করে টিভি দেখা, অনলাইন সিরিজ দেখা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় করে।  

৩. ডিজিটাল বিকল্পের সহজলভ্যতা 
বইয়ের ডিজিটাল বিকল্প, যেমন ই-বুক এবং অডিওবুক, অনেক সহজলভ্য হলেও সেগুলো অনেক পাঠকের কাছে বইয়ের আসল আকর্ষণ ফিরিয়ে দিতে পারে না। একটি মুদ্রিত বই হাতে নিয়ে পড়ার যে আনন্দ, তা ডিজিটাল মাধ্যম প্রদান করতে পারে না। তবুও, প্রযুক্তিগত এই বিকল্পগুলোও মানুষকে বইয়ের প্রতি বিমুখ করে তুলছে। কারণ অনেকেই এখন মনে করেন, বইয়ের পুরোটা পড়ার চেয়ে তার সারাংশ শুনে নেওয়াই যথেষ্ট।  

 ৪. সঠিক পঠনসংস্কৃতির অভাব 
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যায় ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু বর্তমান সমাজে শিশুদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য যে পরিবেশ দরকার, তা প্রায়ই অনুপস্থিত। অভিভাবকরা নিজেরাও বই পড়েন না এবং শিশুদের হাতে মোবাইল বা ট্যাবলেট তুলে দেন। ফলে, শিশুদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে না।  

 ৫. পাঠ্যপুস্তকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি যে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বলতে কেবল পাঠ্যপুস্তক বুঝে। তারা গল্পের বই, উপন্যাস, কবিতা বা জ্ঞানমূলক বই পড়ার সুযোগই পায় না। ফলস্বরূপ, তারা পড়াকে একটি দায়িত্ব মনে করে এবং এটি উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়।  

নিজের অনুভূতি  

বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক ব্যথিত করে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার দিন শুরু হতো এবং শেষ হতো বই পড়ার মাধ্যমে। লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসা এবং সেগুলো পড়ার আনন্দ আমাকে অপরিসীম তৃপ্তি দিত। এখনো যখন কোনো ভালো বই পড়ি, তখন মনে হয় আমি যেন কোনো এক স্বর্গীয় জগতে বিচরণ করছি।  

তবে, বর্তমানে অনেক তরুণের মধ্যে বই পড়ার প্রতি যে আগ্রহের অভাব দেখতে পাই, তা আমাকে হতাশ করে। আমি মনে করি, বই আমাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে, আমাদের মানসিক পরিপক্বতা আনে, এবং আমাদের জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করে। বইয়ের পাতা উল্টানোর সময় যে অনুভূতি হয়, তা মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে পাওয়া যায় না।  

আমার উদ্যোগ, ATReads, এই অভ্যাস পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রচেষ্টা। ATReads হলো একটি বইপ্রেমীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেখানে পাঠকরা বই নিয়ে আলোচনা করতে পারে, নতুন বইয়ের পরামর্শ পেতে পারে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে। এখানে আমি দেখেছি, অনেকেই বই পড়ার পুরনো অভ্যাস ফিরিয়ে এনেছে। এটি আমাকে আশা জোগায়।  

 বই পড়ার অভ্যাস পুনরুদ্ধারে সম্ভাব্য সমাধান  

 ১. বই পড়ার পরিবেশ তৈরি করা 
বই পড়ার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি। এটি হতে পারে বাড়ির একটি নির্দিষ্ট কোণ, যেখানে বইয়ের সংগ্রহ থাকবে এবং পড়ার জন্য আরামদায়ক আসন থাকবে। পরিবারে সবাই মিলে বই পড়ার সময় নির্ধারণ করলে শিশুদের মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহ বাড়বে।  

 ২. বইমেলা ও বইয়ের অনুষ্ঠানের গুরুত্ব
বইমেলা এবং বই-সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলো বইপ্রেমীদের মধ্যে নতুন উচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারে। **ATReads** এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে আমরা বইমেলার তথ্য শেয়ার করি এবং পাঠকদের একত্রিত করি।  

 ৩. ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বই পড়ার প্রচার 
যেহেতু প্রযুক্তি আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, তাই এটিকে কাজে লাগিয়ে বই পড়ার প্রচার করা যেতে পারে। ই-বুক এবং অডিওবুককে আরও আকর্ষণীয় এবং সহজলভ্য করতে হবে। **ATReads** এর মতো প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে।  

৪. স্কুল ও কলেজে বই পড়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা 
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।  

৫. বইয়ের ক্লাব গঠন করা
বইয়ের ক্লাব তৈরি করলে মানুষ একত্রিত হয়ে বই পড়া এবং আলোচনা করতে পারে। এটি বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে সহায়ক। **ATReads**-এ আমরা ভার্চুয়াল বইয়ের ক্লাব চালু করেছি, যা অনেক পাঠককে উৎসাহিত করেছে।  

 

বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া বর্তমান সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে বই থেকে দূরে সরে যাওয়া সহজ হলেও, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এটি কেবল আমাদের মানসিক বিকাশ নয়, আমাদের আত্মিক সমৃদ্ধিতেও সহায়ক।  

আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, বই পড়ার মাধ্যমে যে জ্ঞান ও আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো মাধ্যম দিতে পারে না। **ATReads**-এর মাধ্যমে আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি বই পড়ার সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে বই পড়ার গুরুত্ব তুলে ধরি এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে তুলি। কারণ, একটি ভালো বই শুধু আমাদের জীবনের একটি অংশ নয়, এটি আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক।  

Like
Love
17
Αναζήτηση
Προωθημένο
Κατηγορίες
Διαβάζω περισσότερα
Shopping
Top 10 Eastern Star Gift Ideas: Symbolic Tokens for Members
Eastern Star, a Masonic-affiliated organization open to both men and women, holds deep symbolic...
από Eastern Star Gift(OES) 2024-02-27 12:29:48 11 21χλμ.
Lifelong Learning
নিজের সক্ষমতায় গড়ুন বিশ্বের নতুন গল্প
একটি নতুন যাত্রা শুরু করুন আপনি কি কখনও ভেবেছেন, আপনার জীবনে এমন কিছু অর্জন করার ক্ষমতা রয়েছে,...
από Razib Paul 2024-12-11 07:34:48 2 5χλμ.
Startup
গল্প লেখার সাইট
 লেখক হিসেবে আপনার যাত্রা শুরু করুন ATReads-এ গল্প লেখা একটি শিল্প, যা সময়, স্থান, এবং কাল...
από Bookworm Bangladesh 2025-01-15 08:27:24 0 8χλμ.
Τόπος
সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত স্থান
সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত স্থানসমূহ সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি...
από Khalishkhali 2024-12-05 05:58:46 0 8χλμ.
Book Reviews & Literary Discussions
Book Review: শূন্য (Hardcover) হুমায়ূন আহমেদের শূন্য উপন্যাস
কেন পড়বেন? শূন্য বইটি শুধুমাত্র এক ধরণের সায়েন্স ফিকশন নয়, এটি মানব মন, গণিত, এবং বাস্তবতার...
από Book Club Bangladesh 2025-02-22 14:02:13 0 8χλμ.
AT Reads https://atreads.com