খলিষখালী ইউনিয়নের পাল পাড়া

0
8Кб

খলিষখালী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের এক প্রান্তে নিভৃতপল্লীর মতো বসে আছে একটি গ্রাম—পাল পাড়া। তবে মানুষ একে শুধু পাল পাড়া নামেই চেনে না, বরং বলে বারুইপাড়া। পাল পাড়া, হোড় পাড়া, দাশ পাড়া, আঁশ পাড়া—সবগুলো মিলেই যেন এক পরিবার, আর সেই পরিবারই হলো বারুইপাড়া। এখানকার মানুষ সনাতন ধর্মাবলম্বী, যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মাটি, বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে।

এখানে বাড়ির সংখ্যা খুব বেশি নয়, প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি। ভোটার সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০ জনের মতো। সংখ্যায় হয়তো ছোট, কিন্তু এ গ্রামে প্রতিটি মানুষ যেন একে অপরের পরম আত্মীয়। সুখে-দুঃখে, উৎসবে-অশ্রুতে সবাই মিলে মিশে থাকে। এটাই এ গ্রামের আসল শক্তি।

পান চাষের গ্রাম

ভোর হতেই যখন কুয়াশা ভেজা বাতাস মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই দেখা যায় পাল পাড়ার পুরুষেরা উলু-গুজি, ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন পান বরজে। বরজের ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে সবুজ পাতার সারি, যেন প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়েছে এ গ্রামকে। শিশিরভেজা পানের ডগায় ঝলমল করে সকালের আলো। শ্রমিকরা ঝুঁকে ঝুঁকে বরজ বাঁধে, পান কাটে, ল বাঁধে, আর কাঁচা মাটির গন্ধে ভরে যাচ্ছে চারপাশ।

এই পানই এ গ্রামের প্রধান অবলম্বন। পান ছাড়া যেন পাল পাড়াকে কল্পনা করা যায় না। বিয়ে, পূজা, অতিথি আপ্যায়ন—সবকিছুতেই পান অপরিহার্য। তাই পান এখানে শুধু ফসল নয়, বরং জীবনের রস, অর্থনীতির ভরকেন্দ্র আর সংস্কৃতির প্রতীক।

মানুষ ও তাদের কৃতিত্ব

পাল পাড়ায় জন্ম নিয়েছেন অনেক গুণীজন, যাঁরা এই গ্রামকে করেছেন আলোকিত।
প্রয়াত মধুসূদন পাল, বিদ্যা পাল, নিখিল পাল, কার্তিক পাল—এঁরা শিক্ষক হয়ে শুধু জ্ঞানই দেননি, বরং গ্রামবাসীর চোখে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছেন।
ব্যবসায় ও ব্যাংকিংয়ে অবদান রেখেছেন দ্বীনবন্ধু পাল, কালিপদ দাস, সমীর পাল, সুমন পাল।
আবার আধুনিক শিক্ষার দিগন্ত উন্মোচনে কাজ করছেন রাজীব পাল। তিনি শুধু একজন শিক্ষা উদ্যোক্তা নন, বরং গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন দেখার সাহস জোগানো এক প্রেরণাদাতা। যেখানেই শিক্ষা নিয়ে কোনো উদ্যোগের কথা ওঠে, সবার আগে এগিয়ে আসেন তিনি। গ্রামের শিশুরা যাতে শহরের শিক্ষার্থীদের মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পায়, সেই লক্ষ্যেই তিনি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। আর মিঠুন পাল সি এ হয়ে গ্রামকে গর্বিত করেছেন।
বিষ্ণুপদ হোড়, তাপস হোড়, উজ্জ্বল হোড় শিক্ষাক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রাখছেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় আছেন সুফল আঁশ।

তাঁদের সবার অবদান মিলে আজকের পাল পাড়া শুধু গ্রাম নয়, হয়ে উঠেছে শিক্ষার আলো আর সম্ভাবনার ঠিকানা।

ধর্মীয় ঐতিহ্য

পাল পাড়ার আরেকটি গর্ব হলো এর মন্দিরগুলো। গ্রামে রয়েছে রাধা গোবিন্দ মন্দির, লোকনাথ মন্দির, কালি মন্দির। সন্ধ্যা নামলেই মন্দির প্রাঙ্গণে শঙ্খধ্বনি, ঘণ্টার আওয়াজ আর ভক্তির সুরে ভরে ওঠে চারদিক। পূজা-পার্বণে পুরো গ্রাম যেন উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে যায়। কীর্তনের সুর ভেসে আসে, আলোকসজ্জায় ঝলমল করে উঠতে থাকে প্রতিটি বাড়ি। এই উৎসবগুলো শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক মিলনমেলার কেন্দ্র, যেখানে সবাই একসাথে আনন্দ ভাগ করে নেয়।

সার্বিক চিত্র

সব মিলিয়ে পাল পাড়া এক অনন্য গ্রাম। এখানে মানুষ পরিশ্রমী, ধর্মবিশ্বাসে দৃঢ়, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। পান চাষ তাদের রক্তে মিশে আছে, মন্দির তাদের আত্মার আশ্রয়, আর গুণীজনেরা তাদের পথপ্রদর্শক।

পাল পাড়া শুধু একটি জায়গা নয়, এটি হলো একটি গল্প—মাটির গল্প, মানুষের গল্প, ঐতিহ্যের গল্প।

Like
Love
2
Поиск
Спонсоры
Категории
Больше
Book Reviews & Literary Discussions
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী বই রিভিউ
📖 বই: অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী✍️ লেখক: আহমদ ছফা📚 ধরণ: আত্মজৈবনিক উপন্যাস, প্রেম, জীবনদর্শন আহমদ...
От Book Club Bangladesh 2025-02-22 11:16:29 1 7Кб
Philosophy and Religion
Unlocking the Secrets: Order of the Eastern Star Questions and Answers
Certainly! Here are 30 questions and answers about the Order of the Eastern Star: 1. What is the...
От Lisa Resnick 2023-09-27 06:34:34 3 19Кб
Reading List
Digital Reading Trends in Bangladesh: E-books and Audiobooks on the Rise
In the digital age, where technology permeates every facet of our lives, the realm of literature...
От Book Lovers Bangladesh 2023-12-22 08:13:36 0 17Кб
Writing
আকাশের দিকে তাকালে এখন নতুন কি কি চোখে পড়ছে বা নতুন কি চিন্তা মাথায় আসছে?
আকাশের দিকে তাকালে এখন নতুন অনেক কিছু চোখে পড়ে, যা আগে হয়তো এতটা গভীরভাবে দেখা বা ভাবা হয়নি।...
От Razib Paul 2025-03-02 06:09:05 9 5Кб
Writing
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কেন হয়েছিল?
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি ছিল একটি জাতীয়...
От WriteAhead Bangladesh 2025-03-05 05:48:08 0 6Кб
AT Reads https://atreads.com