শ্রদ্ধেয় বদনা ও ব্যাঙের বিয়ের বেদনা

বাংলাদেশ এক আজব গবেষণাগারের নাম। এখানে বিজ্ঞানের চাইতে সংস্কার বেশি চলে, আর বাস্তবতার চাইতে গুজবের দাম বেশি। এই দেশের মানুষ বৃষ্টি না হলে ছাতা নয়, ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করে। ব্যাঙের কাছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের চেয়ে বেশি বিশ্বাস। ভ্যাঙ ভ্যাঙ করে উঠলেই সবাই ভাবে—এই তো নামবে আকাশভরা বৃষ্টি! কনে ব্যাঙটি প্রায়শই গ্রামের পাশের ডোবায় পাওয়া যায়, বর ব্যাঙ আসে বিশেষ নিমন্ত্রণে, আর আয়োজকরা দই-ভাত খাইয়ে মেঘ দেবতাকে খুশি করার চেষ্টা করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাঙদের বিবাহবিচ্ছেদ কবে হয়, তার খোঁজ কেউ রাখে না। কেবল বিয়ে দিয়েই কাজ শেষ!
এই দেশে ভূত আর জিনেরও বাছবিচার আছে। এরা শুধুমাত্র দরিদ্র, অসহায় এবং চোখে পড়ার মতো সুন্দরী মেয়েদের দেহেই ভর করে। এই অলৌকিকেরা সমাজের মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত বাড়ির কারো দিকে ফিরেও তাকায় না—বোধহয় সেখানে তাবিজে দামি রেট ওঠে না। আর এইসব ভর কাটানোর দায়িত্ব পড়ে সন্ন্যাসী-জটাধারীদের ওপর। এরা সাধারণত দুই প্রকার—একদল হাতে রুদ্রাক্ষ মালা ঝুলিয়ে "ওম" বলে গলা নামায়, আরেক দল জোব্বা পরে এসে আরবি কিছু উচ্চারণ করে "ভর নামো!" জাতীয় স্লোগান তোলে। কেউ কেউ আবার ভর কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে পাত্র ঠিক করার কাজটিও সমাধা করে দেন—এক ঢিলে দুই পাখি!
এখানে বদনা শুধু একটি বস্তু নয়, এটি জাতীয় আবেগ। আপনি যদি প্রবাসে থাকেন এবং হঠাৎ একদিন বাথরুমে গিয়ে বোতল আর টিস্যু নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে হেরে যান, তখনই আপনাকে মনে পড়বে বাংলাদেশের সেই গর্বিত বদনার কথা। আমাদের প্রবাসীরা লন্ডনের চিপায় গোপনে বদনা বহন করেন, যেন কেউ দেখে না ফেলে। আর যারা দেশে থাকে, তারা বদনার প্রতি এতটাই আবেগপ্রবণ যে কেউ কিছু বললেই ‘বদনা হানায়’ উত্তেজনা দেখায়। একথা সত্যি—বদনা আমাদের সংস্কৃতির অদৃশ্য ঐতিহ্য, যার ওপর লেখা হতে পারে একটি পিএইচডি থিসিস: “বদনা ও বাঙালির সম্পর্ক: এক সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ”।
এই দেশের মানুষ ডিমকে ডিম বলেনা, বলেন আন্ডা। ডিম খাওয়ার মতো সহজ কাজও এখানে গর্বের বিষয়। তর্কে হারলে কেউ বলে না, “ঠিক আছে, দেখা যাবে।” বরং বলে, “তোকে কিন্তু গরম আন্ডা খাওয়াব!” একেকটা গরম আন্ডার মধ্যে লুকিয়ে থাকে শতাব্দীর অপমানের প্রতিশোধ।
বাংলাদেশি মানুষের ভয় পাওয়ার ধরনটিও অসাধারণ। রাতের আঁধারে কেউ একা রাস্তায় হাঁটছে—হঠাৎ একটা পাতাও যদি নড়ে, সে থমকে দাঁড়িয়ে বলে, “ওরে বাবারে…” তারপর চোখ বন্ধ করে শুরু করে গান—“সেই রাতের ট্রেন…”। কোনো কিছুর নড়াচড়া মানেই নিশ্চিত ভূত, অথবা কমপক্ষে সশস্ত্র চোর। দৌড় শুরু হয় এমনভাবে, যেন অলিম্পিকের সোনা নিশ্চিত। বাড়ি পৌঁছেই মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরা হয় এবং সেখানেই ঘটে নাটকের ক্লাইম্যাক্স—“মাগো আমি মারা যাচ্ছিলাম… আমি বুঝতে পারছিলাম না… আমি…”
এদেশে প্যাঁচা ডাকলে কেউ ভাবে না, সে খাবার খুঁজছে—সবার ধারণা, অশরীরীরা কনফারেন্স করছে। বাচ্চারা কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ে ভয় পায় না, কিন্তু কেউ হাঁচি দিলে ভাবে—ভূতের হাওয়া! আর এমন দেশেই আবার ‘ব্যাঙ বিয়ে’ দিয়ে বৃষ্টির প্রার্থনা চলে।
বাংলাদেশ মূলত একটি নিরব কৌতুক। এখানে যুক্তির চাইতে যাদুবিদ্যায় বিশ্বাস, বিজ্ঞানের চাইতে ভূতে আস্থা, আর প্রবাসে থেকেও বদনার স্মৃতি আঁকড়ে ধরার আবেগ। আমরা ব্যাঙকে বিয়ে দিই, সুন্দরীদের ভর তাড়াতে তাবিজ নিয়ে দৌড়াই, বদনাকে ঘরছাড়া করতে নারাজ, আর প্রতিপক্ষকে আন্ডার গরমে পোড়াতে চাই।
এই বাস্তবতা হয়তো বিস্ময়কর, কিন্তু এটাই আমাদের রঙিন, বদনা-বিজ্ঞান, ভূত-তাবিজ, ব্যাঙ-বৃষ্টি আর ‘ওরে মারে’ জাতীয় জাতিগত গল্প। হাসুন, কাঁদুন, কিন্তু ভুলবেন না—এই বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র বদনা আর সবচেয়ে কার্যকর জলবায়ু নীতি ব্যাঙের বিয়ে!

- Book Reviews & Literary Discussions
- Writing
- Reading List
- Arts and Entertainment
- Personal Development
- Storytelling
- Startup
- Books
- Biography
- Dance
- Drinks
- Entertainment & Pop Culture
- Health & Fitness
- Education & Learning
- Food & Cooking
- Jogos
- Gardening
- Self-Care & Mental Health
- Home Decor & DIY
- Literature
- Music
- Networking
- Outro
- Party
- Philosophy and Religion
- Local
- Shopping
- Relationships & Dating
- Sports
- Theater
- lifestyles & hobbies/shutterbugs
- Lifelong Learning
- Tutorial
- Announcement
- Inspirational Stories & Motivation