ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের সমালোচনা

0
1K

“দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দা কেনা সম্ভব-! কিন্তু-কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি-না-না-না-না-”
এই আর্তনাদ কেবল একজন ক্রীতদাসের নয়, এটি এক প্রান্তিক মানুষের, এক নিপীড়িত আত্মার আর্ত চিৎকার। শওকত ওসমানের কালজয়ী উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি-র অন্তিম মুহূর্তে হাবশি ক্রীতদাস তাতারীর মুখে উচ্চারিত এই শব্দমালা যেন গোটা উপন্যাসের সারাংশ।

একে যদি সংবেদন দিয়ে অনুভব করতে হয়, তবে পাঠককে ফিরে যেতে হবে ১৯৬০-এর দশকের পাকিস্তানি শাসনামলে, সেই সময়ে যখন সামান্য প্রতিবাদ মানেই শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা।

সেই দুঃসময়েই শওকত ওসমান আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লিখে ফেলেন এমন এক রূপকধর্মী উপন্যাস, যেখানে প্রাচীন বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ আসলে উপমাহাকান্ডে শাসক আইয়ুব খানের প্রতিচ্ছবি, আর সেই বাগদাদের ক্রীতদাস তাতারী হয়ে ওঠে স্বাধীনতাকামী বাঙালির প্রতীক।

উপন্যাসের পটভূমি ও কাহিনিসূত্র

উপন্যাসের সময়কাল আব্বাসীয় খেলাফতের সময়, স্থান বাগদাদ। খলিফা হারুন-অর-রশিদ নিজের বোন আব্বাসাকে হত্যা করেছেন, প্রেমিক জাফরের সাথে প্রণয়ের অভিযোগে। তার অন্তর্দহন এবং বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি দিতে জল্লাদ মশরুর পরামর্শ দেন রাতের বাগানে হাঁটতে যাওয়ার জন্য। এই হাঁটার মাঝেই একদিন খলিফা শুনে ফেলেন এক অদ্ভুত হাসির শব্দ। অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন হাবশি ক্রীতদাস তাতারী ও তার সঙ্গিনী মেহেরজানের উচ্ছ্বল হাসি।

এই প্রাণখোলা হাসির রহস্য জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন খলিফা। তিনি তাতারী ও মেহেরজানকে মুক্ত করে দেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবনে নেমে আসে নতুন শৃঙ্খল। তাতারীকে অঢেল ধনসম্পদ আর সেবাদাস দিয়ে আটকে রাখা হয়, মেহেরজানকে নিয়ে যাওয়া হয় হারেমে। হাসি হারিয়ে যায়, হৃদয়ের আনন্দ নিঃশেষ হয়। তাতারী আর হাসে না।

খলিফা এবার সেই হাসিকে পুনরুদ্ধার করতে উঠে পড়ে লাগেন। কবি আবু নওয়াস ও আবুল আতাহিয়ার সাথে বাজি ধরেন—তাতারী আবার হাসবে। বাগদাদের সুন্দরী বুসায়নাকে পাঠানো হয়, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সে আত্মহত্যা করে। এরপর শুরু হয় নির্যাতন, অপবাদ, অত্যাচার, এমনকি প্রিয়তমার পুনরাগমনের আয়োজন। তবুও তাতারীর মুখে আর সেই হাসি ফুটে ওঠে না।

রূপক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য

‘ক্রীতদাসের হাসি’ শুধু একটি উপন্যাস নয়—এটি এক আত্মিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, বাক-স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি। তাতারীর মুখে উচ্চারিত “হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি” বাক্যটি যেন বাঙালির স্বাধীনতার কাব্যিক পূর্বাভাস। এই উপন্যাসে আরব্য রজনীর পটভূমিকে ব্যবহার করে লেখক রক্ষা পেয়েছেন সেন্সরের কাঁচি থেকে, আর পাঠক পেয়েছেন এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদের ভাষা।

খলিফার কাছে দাসত্ব মানে শারীরিক শৃঙ্খল, কিন্তু তাতারীর কাছে তা আত্মার গ্লানি। উপন্যাসটি প্রমাণ করে অর্থ দিয়ে মানুষের শরীর কেনা গেলেও আত্মা নয়। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ভালোবাসার মর্যাদা আর কেড়ে নেওয়া যায় না। খলিফা তার অঢেল ক্ষমতা নিয়েও তাতারীর সেই প্রাণবন্ত হাসিকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন—কারণ তাতারী হাসে আত্মার মুক্তিতে, ক্রীতদাসের জীবনের সূর্যকিরণে।

রচনাশৈলী ও সাহিত্যমূল্য

এই উপন্যাসে অধিকাংশই সংলাপনির্ভর, কিছু অংশে রয়েছে ‘স্টেজ ডিরেকশন’-এর মতো নাটকীয় বর্ণনা, যা একে নাটকের সঙ্গে সংলগ্ন এক নতুন সাহিত্যরূপ দেয়। এই শৈল্পিক নিরীক্ষাও একে বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে।

চরিত্রগুলো মূলত প্রতীকী—খলিফা স্বৈরশাসকের রূপ, মশরুর অন্ধ আনুগত্যের প্রতীক, বুসায়না ভোগবাদী সমাজের আত্মবিক্রয়ের রূপ, আর তাতারী হয়ে ওঠে প্রতিবাদী আত্মার প্রতিধ্বনি। একমাত্র ব্যতিক্রম কবি আবু নওয়াস, যিনি রসবোধ, বিদ্রুপ ও এক গভীর জীবনদর্শনের মাধ্যমে পাঠকের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকেন।

‘ক্রীতদাসের হাসি’ একদিকে সাহিত্যের, অন্যদিকে রাজনীতির ইতিহাস। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্থ বা ক্ষমতার দাসত্বে নয়, বরং আত্মার অভ্যন্তরে নিহিত।

শওকত ওসমান আইয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলেন এই উপন্যাসের জন্য—এ যেন সেই শাসকের মুখে প্রতিবাদের হাসি ছুঁড়ে দেওয়ার আরেক শিল্পচাতুর্য। তার এই সাহিত্য-প্রতিবাদ আজো অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকে, প্রতিটি সেই কণ্ঠের ভেতরে, যারা চায়–
“প্রাণ খুলে একবার হাসতে, সত্যিকারভাবে, স্বাধীনভাবে।”

Buscar
Patrocinados
Categorías
Read More
Literature
আরিফ আজাদ কে?(Arif Azad)
একুশে বইমেলার বেস্টসেলার, একজন জীবন্ত আলোকবর্তিকা বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে যে কয়জন লেখক আধুনিক...
By Bookworm Bangladesh 2025-03-05 07:14:33 0 2K
Philosophy and Religion
Celebrating the Tapestry of Tradition: Puja Parvan in Khalishkhali Village
Khalishkhali village, nestled within the heart of its expansive landscape, resonates with the...
By Khalishkhali 2024-02-05 06:49:13 0 8K
Education & Learning
পাটিগণিতের সূত্র সমূহ?
পাটিগণিত (Algebra) গণিতের একটি মৌলিক শাখা, যা সংখ্যা, ভেরিয়েবল, এবং অক্ষরের মাধ্যমে সম্পর্কের...
By Knowledge Sharing Bangladesh 2024-12-21 13:29:01 4 2K
Writing
What is a Common Challenge in Writing a Proposal?
Writing a proposal is a critical skill in many professional fields—from securing funding...
By Bookworm Bangalore 2025-02-12 13:28:28 0 2K
Book Reviews & Literary Discussions
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী কাকে নিয়ে লেখা?
আহমদ ছফার "অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী" উপন্যাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো কথক জাহিদ এবং তাঁর প্রেয়সী...
By Book Club Bangladesh 2025-02-22 11:27:34 1 2K
AT Reads https://atreads.com