১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যা জান লেখ

0
253

ভূমিকা

ভাষা মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রধান বাহক। একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার এক গৌরবময় সংগ্রাম।

এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি তার জাতিসত্তার ভিত্তি গড়ে তোলে, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হওয়ার শক্তি যুগিয়েছিল।

মাতৃভাষার জন্য এমন রক্তক্ষয়ী আন্দোলন বিশ্ব ইতিহাসে বিরল, এবং এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।


ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত এই রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত ছিল—পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)।

পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন—পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% মানুষ বাংলায় কথা বলত। তবুও ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ঢাকার নবাব পরিবারের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা এই প্রস্তাবকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং বাংলা ভাষার গুরুত্বকে অস্বীকার করে। এরপর থেকেই বাংলার জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।


ভাষা আন্দোলনের ক্রমবিকাশ

ভাষা আন্দোলন একদিনে সংঘটিত হয়নি; এটি ছিল ধাপে ধাপে সংগঠিত একটি দীর্ঘ সংগ্রাম।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধাক্কা

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় প্রথম বড় পরিসরে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট আহ্বান করে এবং পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালায় এবং বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে।

১৯৪৯-১৯৫১: আন্দোলনের প্রস্তুতি

এই সময়ে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আবুল কাসেম, রফিকুল ইসলামসহ অনেক তরুণ নেতা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।


১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি: রক্তাক্ত অধ্যায়

১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণার পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

১৪-২০ ফেব্রুয়ারি: উত্তাল ঢাকা

ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ধর্মঘট ও প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

২১ ফেব্রুয়ারি: ইতিহাসের কালো দিন

সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা এই নিষেধাজ্ঞা মানবে না। ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে ছাত্ররা জড়ো হয়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে তারা মিছিল বের করে।

গোলাগুলি ও শহীদদের আত্মত্যাগ:
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসার পর পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালায়। এতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক ভাষাসৈনিক শহীদ হন। এই বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্য রক্তের সিঁড়ি রচিত হয়।

২২-২৩ ফেব্রুয়ারি: শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা ও বিক্ষোভ

শোকাবহ পরিবেশে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা প্রতিবাদস্বরূপ ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু করে। এই শহীদ মিনার পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে।


ভাষা আন্দোলনের সফলতা ও প্রভাব

ভাষা আন্দোলনের ফলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলে।
২. ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান: ভাষা আন্দোলনের চেতনা পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে অনুপ্রাণিত করে।
3. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ: ভাষা আন্দোলনই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করেছিল।


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও গৌরব

ভাষা আন্দোলনের এই অনন্য দৃষ্টান্তের স্বীকৃতি দিতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এখন এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতীক হিসেবে পালিত হয়।


উপসংহার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রাম ছিল না; এটি ছিল এক আত্মপরিচয়ের আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলনের সূচনা। শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অন্যদের আত্মত্যাগ আমাদের গর্বিত করে এবং আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার শপথ নেয়ায় বাধ্য করে। আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব হল বাংলা ভাষার যথাযথ চর্চা ও প্রচার করা, যেন ভবিষ্যতেও এ ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।

Like
Yay
3
Site içinde arama yapın
Sponsorluk
Kategoriler
Read More
Books
বই পড়ার ১০ টি উপকারিতা
বই পড়া আমাদের জীবনের একটি অমূল্য অভ্যাস। এটি কেবল একটি শখ বা সময় কাটানোর উপায় নয়, বরং মানুষের মন...
By Razib Paul 2024-11-28 15:05:32 0 1K
Dance
বেঙ্গলি থিয়েটার কে কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
বেঙ্গলি থিয়েটার প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন রুশ মনীষী লেবেদেফ। তিনি ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ডোমতলায়...
By Bangla Book Review 2025-01-15 05:56:05 0 733
Literature
ADORATION IN THE EYES OF THE BEHOLDER
Eros:  Eros is the Greek god of love. It represents romantic or passionate love. This one...
By Pallavi Ghosh 2024-04-05 14:12:54 8 5K
Book Reviews & Literary Discussions
Book Review: I Got Abducted by Aliens and Now I'm Trapped in a Rom-Com by Kimberly Lemming
Series: Cosmic Chaos #1 Published by: Berkley on February 18, 2025 Genre:...
By Books of the Month 2025-02-16 05:43:23 2 606
Entertainment & Pop Culture
শোবিজ তারকাদের সঙ্গে মাদকের সংযোগ: এক অদ্ভুত সমীকরণ
বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি এবং তারকাদের সঙ্গে মাদক সংযোগের বিষয়টি অনেক সময়ই আলোচিত ও সমালোচিত হয়ে থাকে।...
By Shopna Maya 2024-12-20 12:19:28 2 1K