গাভী বিত্তান্ত রিভিউ: বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজের অন্তরঙ্গ প্রতিচ্ছবি

0
1K

📖 আপনার পড়ার তালিকায় "গাভী বিত্তান্ত" থাকছে তো?

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে কী ঘটে? কেন ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব আর প্রশাসনের জটিলতা শিক্ষার চেয়ে বেশি আলোচিত? আহমদ ছফার "গাভী বিত্তান্ত" ঠিক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয় তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক ভাষায়!

এই উপন্যাস শুধু গল্প নয়, এটি আমাদের সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি আর ক্ষমতার দৌরাত্ম্যের বাস্তব প্রতিফলন। ১৯৯৫ সালে লেখা হলেও বইটির প্রতিটি লাইন আজও সমান প্রাসঙ্গিক, সমান শাণিত।

📌 কেন পড়বেন?
✅ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে চমৎকার ব্যঙ্গ-রসের মাধ্যমে।
✅ ছাত্ররাজনীতি, ক্ষমতার লড়াই আর প্রশাসনের জটিলতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে।
✅ ছফার গভীর পর্যবেক্ষণ ও লেখার ধারা পাঠককে মুগ্ধ করবে।
✅ একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না!

এটি শুধু একটি বই নয়, বরং সময়ের দর্পণ। তাই আর দেরি না করে "গাভী বিত্তান্ত" সংগ্রহ করুন এবং বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এক সাহসী সাহিত্যকর্ম উপভোগ করুন!

 

প্রথমেই বলতে হয়, "গাভী বিত্তান্ত" আমার কাছে দারুণ লেগেছে। আহমদ ছফার অনেক বই সংগ্রহে রেখেছি, কিন্তু কেন জানি পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে ঠিক সেই সময়ই এই বইটি হাতে নিলাম, যখন নিজের জীবনের প্রতি কিছুটা হতাশা ও বিরক্তি অনুভব করছিলাম। অনেকদিন ধরে বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর এই উপন্যাস যেন নতুন করে সবকিছু শুরু করার এক উপলক্ষ এনে দিল।

একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতিচিত্র

"গাভী বিত্তান্ত" নিছক একটি উপন্যাস নয়; এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, শিক্ষকদের দ্বিচারিতা, ছাত্ররাজনীতির কূটকৌশল—সবকিছুকে ব্যঙ্গ করে তোলা একটি সাহসী সাহিত্যকর্ম। ছফার লেখার মধ্যে স্যাটায়ার ও সারকাজমের যে তীব্র প্রয়োগ রয়েছে, তা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীর সংকটকে উন্মোচিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক বিশৃঙ্খল রাজনীতির চক্রব্যূহ, যেখানে ক্ষমতা আর প্রভাব বিস্তারের নোংরা খেলা চলে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নিজে তার ঐতিহ্যগত পথেই এগিয়ে যায়, অচল কাঠামোর মতো।

প্লট সংক্ষেপ

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ—একজন রসায়ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষক, যিনি হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে নিযুক্ত হন। তার নিস্তরঙ্গ জীবন মুহূর্তেই বদলে যায়। প্রশাসনিক দায়িত্ব, রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ, সহকর্মীদের স্বার্থপরতা এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামলাতে গিয়ে তিনি একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েন। ক্ষমতার সাথে আসা চাপ ও কুটিলতা থেকে মুক্তি পেতে তিনি এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেন—একটি গাভী কিনে উপাচার্যের বাংলোয় গোয়ালঘর তৈরি করেন। গাভীটি যেন তার জন্য এক আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, যেখানে নেই কোনো রাজনৈতিক কূটকৌশল, নেই দলাদলি বা ষড়যন্ত্র।

ছফার তীক্ষ্ণ সমাজচিত্রণ

ছফার লেখনীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অবস্থা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে—

👉 "সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্ররা মিছিল করে এসে উপাচার্যের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলেছে, কারণ তাদের পরীক্ষা বারবার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দরজা-জানালা নতুন করে মেরামত করা হলে সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্ররা পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবিতে আবার সেই দরজা-জানালা ভেঙে দিল!"

👉 "তিরিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে এক হাজার কবি, সংখ্যাটা কিছুতেই অধিক বলা যাবে না। বাঙালি মাত্রই কবি।"

এই লাইনগুলো পড়লেই বোঝা যায়, ছফা কেবল হাস্যরস তৈরি করতে চাননি; বরং তিনি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, যা আজও একইভাবে প্রাসঙ্গিক। শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ছাত্ররাজনীতির নাটকীয়তা, প্রশাসনের অদক্ষতা—সবকিছুই উপন্যাসের পাতায় তীক্ষ্ণভাবে উঠে এসেছে।

এক অনন্য রাজনৈতিক রূপকথা

এই উপন্যাস কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গল্প বলে না; এটি আসলে ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং মানুষের সীমাবদ্ধতা নিয়ে লেখা এক অনন্য রাজনৈতিক রূপকথা। উপাচার্য হয়ে আবু জুনায়েদ উপলব্ধি করেন, ক্ষমতা লাভের চেয়ে সেটার সঠিক ব্যবহার করা অনেক কঠিন। তার চারপাশের লোকেরা ধূর্ত, লোভী, স্বার্থপর—যারা কেবল নিজেদের সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে। তিনি পারিবারিক জীবনেও অসুখী হয়ে ওঠেন। তাই গাভীটি হয়ে ওঠে তার মানসিক শান্তির একমাত্র উৎস, যেখানে নেই কোনো কূটচাল, নেই কোনো প্রতারণা।

শেষ কথা

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আহমদ ছফার তুলনা অত্যন্ত গভীর—তিনি এটিকে আত্মার সঙ্গে তুলনা করেছেন। শতাব্দীর প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটির ইট-পাথর, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য ঠিকই বহাল থাকে, কিন্তু এর অন্তরজগৎ কীভাবে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেটিই তিনি দেখিয়েছেন। ১৯৯৫ সালে লেখা হলেও উপন্যাসটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, যা আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা ও সংকট নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

"গাভী বিত্তান্ত" শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি আমাদের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার এক নির্মম প্রতিবিম্ব। যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ভালোবাসেন, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চান বা সাহসী সাহিত্য পড়তে চান, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য।

🌟 রেটিং: ৪.৮/৫ 🌟

📖 বইটি কিনতে এখানে ক্লিক করুন

 

Like
2
Căutare
Sponsor
Categorii
Citeste mai mult
Education & Learning
The Spirit of Laws গ্রন্থের লেখক কে?
'The Spirit of Laws' (মূল ফরাসি নাম: De l'esprit des lois) গ্রন্থের লেখক হলেন মন্টেস্কিউ...
By Pakhi Sarkar 2024-12-01 06:13:02 0 2K
Reading List
Exploring Bangladeshi Literature: A Journey Through Contemporary Authors
Bangladeshi literature, a rich tapestry woven with the threads of history, culture, and societal...
By Book Club Bangladesh 2023-12-22 08:43:57 0 8K
Books
সাইফুরস স্টুডেন্ট ভোকাবুলারি – সাইফুর রহমান খান - Saifurs
আপনার ইংরেজি শব্দভাণ্ডার (Vocabulary) কি দুর্বল? পরীক্ষায় ভালো করতে বা আত্মবিশ্বাসের সাথে...
By Book Club Bangladesh 2025-02-16 13:04:18 0 2K
Philosophy and Religion
The Journey Within: Navigating the Spiritual Path at ISKCON Boston
In the bustling heart of Boston, amidst the ebb and flow of urban life, lies a sanctuary of...
By ISKCON Boston 2023-12-31 11:57:29 0 9K
Tutorial
Teachers Social Media.
No longer just a space for entertainment, it now serves as a powerful platform for teachers to...
By ATReads Editorial Team 2025-03-09 12:10:36 2 2K
AT Reads https://atreads.com