চৈতন্যের জগৎ বনাম ভোগের জগৎ: ভারতীয় আত্মার এক অনুপম বিজ্ঞান

0
9χλμ.

আমরা আজ এমন এক কালে বাস করছি, যেখানে ভোগের আকাঙ্ক্ষা আমাদের অস্তিত্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। মনুষ্যজীবনের সত্য সৌন্দর্য, চেতনার দীপ্তি, আত্মার প্রকৃত অনুসন্ধান যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। চৈতন্যবিজ্ঞানের মতো গূঢ় অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় আজ অজ্ঞতার ধুলায় চাপা পড়ে আছে। আমরা বুঝি না—চৈতন্যহীন জীবনের মানে, এক অজানা ভারতবর্ষে বসবাস, যার সূচনা ঘটে বহু আগেই, বৈদেশিক মুসলমান আগ্রাসনের যুগ থেকে।

এই আঘাত শুধু শাসনতন্ত্রে নয়, আত্মার স্তরে আঘাত হেনেছে। ভারতবাসী হয়ে পড়লো কোমাগ্রস্ত, প্রাণহীন, সংজ্ঞাহীন। মৃতপ্রায় এক অসুস্থ জাতির চিকিৎসার প্রয়োজন হলো—স্পিরিচুয়াল ইনটেনসিভ কেয়ারের। এই ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন সেই অদ্ভুত ‘ডাক্তার’—শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। নবদ্বীপে ১৪৮৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম, আর ১৫১০ সালের ১০ জানুয়ারি কাটোয়াতে সন্ন্যাস গ্রহণ করে শুরু করলেন চিকিৎসার মূল অধ্যায়।

শুধু ধর্ম নয়, তাঁর ছিল এক অনুপম চৈতন্যবিজ্ঞান। রাধা ও কৃষ্ণকে জীবাত্মা ও পরমাত্মার প্রতীক করে দেখালেন—ভর (Mass) যদি শক্তি (Energy) হতে চায়, তবে চাই ইমোশন বা প্রেম, যা আলোর বেগের বর্গের মতো রূপান্তর ঘটায়। শ্রীচৈতন্য নিজেই হয়ে উঠলেন সেই রূপান্তরের প্রতীক—অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ। তাঁর পরিব্রাজন (১৫১০-১৫১৫) এবং নীলাচল পর্বে (১৫১৫-১৫৩৩) ভারতীয় আত্মায় নতুন প্রাণসঞ্চার করলেন।

এই মহাপ্রয়াসের পরেও শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেল, আবারও ভারতবাসী চৈতন্যহীনতায় আক্রান্ত হলো। আর সেই সময়েই কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু রূপে ঘোষণা করলেন, “চৈতন্য হোক”—এ যেন মহাপ্রভুর বিজ্ঞানকেই আধুনিক সময়ে নতুন ভাষায় উপস্থাপন। শাক্তসাধকের প্রার্থনা যেন তারই অনুরণন—“আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী।”

জগদীশচন্দ্র বসু এই চৈতন্যকে খুঁজলেন প্রকৃতির রহস্যের গভীরে। পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, মনোবিজ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি বললেন, “ভারতীয় চিন্তাধারা ছুটেছে একতার সন্ধানে।” তাঁর ভাষায়, প্রকৃতির অন্তরেও আছে অখণ্ড চৈতন্য। শক্তি, ভর ও ব্যোম—এই ত্র্যহস্পর্শের যে রূপ, তা যেন ভারতীয় দর্শনের ‘সৎ-চিত-আনন্দ’-এর আধুনিক প্রতিধ্বনি।

আইনস্টাইনের E=mc² সূত্রে আমরা দেখি—ভর ও শক্তির রূপান্তরে মূল ভূমিকা ‘c²’, অর্থাৎ একটি গুণক শক্তি। শ্রীচৈতন্যের দর্শনে এই গুণক হল প্রেম, ইমোশন। প্রেমহীন জগতে শক্তি নেই, পরিবর্তন নেই, বিকাশ নেই। প্রেমই ভরের মধ্যে প্রাণপ্রবাহ এনে দেয়, জীবাত্মাকে পরমাত্মার দিকে নিয়ে যায়।

ভারতবর্ষের এই চৈতন্যচর্চা কেবল ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক, মানবিক, এবং পরমার্থিক এক যাত্রা। যখন সমাজ ভেঙে পড়ছিল, তখন নিম্নবর্ণের মধ্যেও হরিভক্তি প্রচার করে তিনি চৈতন্যকে সর্বজনীন করে তুললেন। সাম্য, প্রেম, এবং আত্ম-উন্মোচনের যে পথ তিনি দেখালেন, তা আজও আধুনিক সমাজের জন্য এক আলোকবর্তিকা।

আজ যখন আমরা আবারও বিভ্রান্ত, আবারও আত্মবিস্মৃত, তখন শ্রীচৈতন্যের চৈতন্যবিজ্ঞান আমাদের নতুন করে পথ দেখাতে পারে। ভারতবর্ষ যদি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেতে চায়, তবে তাকে ফিরতে হবে সেই আত্মাভিমুখী বিজ্ঞানের দিকে—যেখানে চৈতন্যই শেষ সত্য, এবং প্রেমই তার রূপান্তরের সূত্র।

Αναζήτηση
Προωθημένο
Κατηγορίες
Διαβάζω περισσότερα
Writing
সব শিক্ষা বইয়ের পাতা থেকে হয়না, কিছু শিক্ষা – পরিস্থিতি আর বাস্তবতা শিখিয়ে দেয়।
আমাদের সমাজে শিক্ষাকে সাধারণত পাঠ্যবই আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করা হয়।...
από Razib Paul 2025-03-06 05:53:02 0 7χλμ.
Education & Learning
Write a Letter to Your Younger Brother Who is Bookworm
Writing a letter to your younger brother who loves books can be a wonderful way to encourage his...
από Books of the Month 2025-02-11 06:19:54 2 4χλμ.
Writing
2 ছাড়া প্রত্যেক জোড় সংখ্যা মৌলিক না যৌগিক তা লিখি
সংখ্যা তত্ত্বের জগতে, এক অসাধারণ ও সহজবোধ্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি রয়েছে: ২ ছাড়া প্রত্যেক...
από Bookworm Bangalore 2025-02-12 14:28:54 0 5χλμ.
Education & Learning
থেমে থাকা বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে যাত্রীরা পিছনের দিকে হেলে পড়ে কেন ব্যাখ্যা কর?
থেমে থাকা বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে যাত্রীরা পিছনের দিকে হেলে পড়ে এর মূল কারণ হলো নিউটনের প্রথম...
από Knowledge Sharing Bangladesh 2025-03-02 05:43:31 5 7χλμ.
Philosophy and Religion
ধর্ম ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে কবরদান পদ্ধতি
মৃত্যু, যা পৃথিবী জীবনের শেষ পরিণতি হিসেবে চিহ্নিত, প্রতিটি সংস্কৃতি ও ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন ধারণায়...
από Razib Paul 2025-01-22 08:15:27 0 5χλμ.
AT Reads https://atreads.com