ক্ষিতিমোহন সেনের মতে, সাহিত্য সংগ্রহের পথিকৃৎ বাংলার মাটিতে, যেখানে প্রায় হাজার বছর আগে বৌদ্ধ পণ্ডিত বিদ্যাধর সংকলিত করেন শতাধিক কবির কবিতা নিয়ে "কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়"। পরবর্তীতে, শ্রীধরদাসের "সদুক্তিকর্ণামৃত" (১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং ষোলো শতকে শ্রীরূপ গোস্বামীর "পদ্যাবলী"তে ভক্ত কবিদের রচনা সংগ্রহ করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ "পদরত্নাবলী" সম্পাদনা করেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, বাংলা সাহিত্যে সংকলনের ধারা এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

সম্প্রতি প্রকাশিত অরুণাভ সিংহের সম্পাদিত "দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়" এই ঐতিহ্যেরই অংশ, যেখানে ৩৭টি গল্প বেছে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৩২ বছরের সময়কাল থেকে। বইটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের "ঘাটের কথা" দিয়ে, যা আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের সূচনাপর্ব বলে মানা হয়। রবীন্দ্রনাথের এই গল্প বিধবা কুসুমের প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত, যা ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের সামাজিক পরিবর্তন এবং বিশ শতকে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাব বইটির মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে।

অরুণাভ সিংহের ভূমিকা থেকে জানা যায়, এই সংগ্রহে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, মার্ক্সবাদী সাহিত্য আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং দেশভাগের পরবর্তী কালের গল্প স্থান পেয়েছে। বইটিতে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও গল্প সংযোজন করা হয়েছে, যা এই সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

বাংলা গল্পের নির্মাণশৈলী এবং ভঙ্গিমার নানা দিককেও এখানে আলোচিত হয়েছে। ষাটের দশকে সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে লেখকরা তাদের গল্পের কাহিনি ও রীতিতেও পরিবর্তন আনেন। অরুণাভ সিংহ এই ভূমিকায় উল্লেখ করেন, কাহিনি শৈলীকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্য কীভাবে নতুন আঙ্গিকে বিকশিত হয়েছে, বিশেষ করে ষাট-সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়কালে। গল্পগুলোতে সেই সময়ের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ছাপ স্পষ্ট, যা গল্পের ঘটনাবিন্যাস এবং চরিত্রগুলোতে ফুটে ওঠে।

তবে, এই সংগ্রহের গল্পগুলো প্রধানত সম্পাদক অরুণাভ সিংহের ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে নির্বাচিত, এবং তিনি কোন বিশেষ নীতির অনুসরণ করেননি বলে উল্লেখ করেছেন। বইটির সূচনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে এবং সমাপ্তি সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে।

গল্প সংকলনে শরৎচন্দ্র, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবীর মতো পরিচিত লেখকদের জনপ্রিয় কিছু গল্প স্থান পেয়েছে, যা বাংলা গল্প সংগ্রহের ধারায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত কাহিনিগুলোকেই অনুসরণ করে। এ সংকলনে পুরনো ও নতুন গল্পের সংমিশ্রণ হলেও কিছু আধুনিক রচনার অভাব রয়েছে।

সম্পাদনায় কিছু তথ্যে অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়, যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের "দুর্গেশনন্দিনী"কে প্রথম বাংলা উপন্যাস বলা হলেও প্যারীচাঁদ মিত্রের "আলালের ঘরের দুলাল"ই আদতে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে গৃহীত। একইভাবে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাস্তবে সামান্য কম।

বইটির প্রচ্ছদে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কোলাজ ব্যবহৃত হয়েছে যা একে দৃষ্টিনন্দন রূপ দিয়েছে। এই সংগ্রহটি বাঙালি ও অবাঙালি পাঠকদের জন্য বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য ও পরিবর্তনের এক চমৎকার উপলব্ধি এনে দেয়। অরুণাভ সিংহের অনুবাদ দক্ষতা বইটির অন্যতম প্রভাবশালী দিক, যেখানে ৩৭টি গল্পের মধ্যে ৩২টি তার অনূদিত।
#bookwormbangladesh
ক্ষিতিমোহন সেনের মতে, সাহিত্য সংগ্রহের পথিকৃৎ বাংলার মাটিতে, যেখানে প্রায় হাজার বছর আগে বৌদ্ধ পণ্ডিত বিদ্যাধর সংকলিত করেন শতাধিক কবির কবিতা নিয়ে "কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়"। পরবর্তীতে, শ্রীধরদাসের "সদুক্তিকর্ণামৃত" (১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং ষোলো শতকে শ্রীরূপ গোস্বামীর "পদ্যাবলী"তে ভক্ত কবিদের রচনা সংগ্রহ করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ "পদরত্নাবলী" সম্পাদনা করেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, বাংলা সাহিত্যে সংকলনের ধারা এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সম্প্রতি প্রকাশিত অরুণাভ সিংহের সম্পাদিত "দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়" এই ঐতিহ্যেরই অংশ, যেখানে ৩৭টি গল্প বেছে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৩২ বছরের সময়কাল থেকে। বইটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের "ঘাটের কথা" দিয়ে, যা আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের সূচনাপর্ব বলে মানা হয়। রবীন্দ্রনাথের এই গল্প বিধবা কুসুমের প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত, যা ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের সামাজিক পরিবর্তন এবং বিশ শতকে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাব বইটির মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। অরুণাভ সিংহের ভূমিকা থেকে জানা যায়, এই সংগ্রহে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, মার্ক্সবাদী সাহিত্য আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং দেশভাগের পরবর্তী কালের গল্প স্থান পেয়েছে। বইটিতে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও গল্প সংযোজন করা হয়েছে, যা এই সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বাংলা গল্পের নির্মাণশৈলী এবং ভঙ্গিমার নানা দিককেও এখানে আলোচিত হয়েছে। ষাটের দশকে সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে লেখকরা তাদের গল্পের কাহিনি ও রীতিতেও পরিবর্তন আনেন। অরুণাভ সিংহ এই ভূমিকায় উল্লেখ করেন, কাহিনি শৈলীকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্য কীভাবে নতুন আঙ্গিকে বিকশিত হয়েছে, বিশেষ করে ষাট-সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়কালে। গল্পগুলোতে সেই সময়ের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ছাপ স্পষ্ট, যা গল্পের ঘটনাবিন্যাস এবং চরিত্রগুলোতে ফুটে ওঠে। তবে, এই সংগ্রহের গল্পগুলো প্রধানত সম্পাদক অরুণাভ সিংহের ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে নির্বাচিত, এবং তিনি কোন বিশেষ নীতির অনুসরণ করেননি বলে উল্লেখ করেছেন। বইটির সূচনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে এবং সমাপ্তি সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে। গল্প সংকলনে শরৎচন্দ্র, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবীর মতো পরিচিত লেখকদের জনপ্রিয় কিছু গল্প স্থান পেয়েছে, যা বাংলা গল্প সংগ্রহের ধারায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত কাহিনিগুলোকেই অনুসরণ করে। এ সংকলনে পুরনো ও নতুন গল্পের সংমিশ্রণ হলেও কিছু আধুনিক রচনার অভাব রয়েছে। সম্পাদনায় কিছু তথ্যে অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়, যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের "দুর্গেশনন্দিনী"কে প্রথম বাংলা উপন্যাস বলা হলেও প্যারীচাঁদ মিত্রের "আলালের ঘরের দুলাল"ই আদতে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে গৃহীত। একইভাবে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাস্তবে সামান্য কম। বইটির প্রচ্ছদে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কোলাজ ব্যবহৃত হয়েছে যা একে দৃষ্টিনন্দন রূপ দিয়েছে। এই সংগ্রহটি বাঙালি ও অবাঙালি পাঠকদের জন্য বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য ও পরিবর্তনের এক চমৎকার উপলব্ধি এনে দেয়। অরুণাভ সিংহের অনুবাদ দক্ষতা বইটির অন্যতম প্রভাবশালী দিক, যেখানে ৩৭টি গল্পের মধ্যে ৩২টি তার অনূদিত। #bookwormbangladesh
Love
1
0 Comentários 0 Compartilhamentos 3KB Visualizações 0 Anterior
AT Reads https://atreads.com